রফিক আজাদ বাংলা সাহিত্যের গত শতাব্দীর ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই কবি যে আলাদা কবিতার ধরন তৈরি করেছেন, তা বলা বাহুল্য। আধুনিকতার সব কটি বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, দেশাত্মবোধ, নারী স্বাধীনতা, মূল্যবোধ, ইতিহাস চেতনা, সমাজ ভাবনা, ঐতিহ্যপ্রীতি ইত্যাকার উপাদান তাঁর কাব্যিক বোধবুদ্ধিকে সুষমামণ্ডিত করে তোলে। এ অর্থে তিনি বাংলা কবিতায় সবিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
রফিক আজাদের কাব্যগুলো অভিব্যক্তিবাদের চেতনায় মূর্ত হয়ে ওঠে, যা সমকালীন যুগধর্মের প্রবীণতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিভাত। কবিতার অন্য সব বাহ্যিক উপাদান ছড়িয়ে একটা অনুরণন সৃষ্টি হয়। ফলে এসব কবিতা পাঠক সাধারণের মনকে আবিষ্ট করে রাখতে সক্ষম। আমরা পড়ি আলোচ্য বইয়ের তার ‘দাঁড়াবো এবার’ কবিতা থেকে, ‘দুশ্চিন্তিত বটে এই দৃশ্যে! কেন বা হবো না বলো/ মানুষ কি সর্বদাই ব্যাকরণ মেপে ফেলবে পা/ তার সে চলার পথে?—কে দিব্যি দিয়েছে এ-ব্যাপারে,/ বোধের অগম্য মানি, পা দুটি আমার সর্বদাই/ মানবে আমাকে শুধু? পদস্খলিত কি হ’তে নেই—/ হবে না কখনো? কভু পারবে না বিদ্রোহ করতে/ আমার বিরুদ্ধে পা-দুখানি? আমি নিজে দেহে-মনে/ তা’হলে কি তৈরি নই দেয়ালের অপর দিকটি/ দেখার—শোনার? তবে তো ‘মনুষ্য’ পদবাচ্য নই/ সারাটা জীবন তবে ভবিতব্য জেনে, মান্য করে যাব ব্যতিক্রমহীন তুচ্ছ এই নিয়ম-কানুন?’
এই রকম চিন্তা-চেতনা থেকেই কবি নানামাত্রিক আয়োজনে উচ্চকিত হন। এর মধ্যে প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রেম। প্রেমের বর্ণবহুল আবেগময়তা কবির এই বোধবুদ্ধিকে আরো শাসিত করে তোলে। প্রেম, বিরহ, মিলন, অভিসার চেতনায় তা অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে। আমরা পড়ি তার ‘কোন ঠিকানায়’কবিতায়, ‘কতো দূরে/ কার স্বদেশে/ এ শ্রাবণে/ কোন ঠিকানায়/ বৃষ্টি ঝরে যাও?/ গভীর গোপন/ দীর্ঘশ্বাসে/ একাকী এই/ শ্রাবণ রাতে/ আমার এ ক্ষণ গোনা;/ মেঘকন্যে/ তোমার জন্যে/ তৃষ্ণা আমার/ আজো অব্দি/ বক্ষ জুড়ে আছে…’
এইভাবে প্রকৃতিপ্রাণতার সাথে বরাবরই কবির অচ্ছেদ্য বন্ধন লক্ষণীয়। কবি ও প্রকৃতি অনেক স্থলেই একাকার অথবা একে অন্যের দোসর। তাঁর কবিভাবনায়ও অনুরূপ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি নারী ও প্রেমের মহিমা তুলে ধরেন।
রফিক আজাদের কাব্য ও কাব্যিকতা বাংলা সাহিত্যের এক অনিবার্য অধ্যায়। তাঁর শব্দচয়ন বাক-ভঙ্গিমা অলঙ্কার-অন্বেষণা, রসবিচার, ভাববিন্যাস, ইতিহাস চেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি প্রায় সবই এ দেশের সমূল-সংস্কৃতিতে স্বীয়করণ করে গড়ে ওঠে। তা একটা সার্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
Reviews
There are no reviews yet.