“বিষয় চলচ্চিত্র” বইটি সম্পর্কে কিছু কথা :
একটা দেশে খাটি শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র তৈরি হবে কী করে, যদি তা সঠিকভাবে বোঝার মতন দর্শক না থাকে? শুধু দু’চারজন বোদ্ধার জন্য ছবি তৈরি করা যায় না। চলচ্চিত্র একটি বৃহৎ শিল্প, বহু আয়োজন এবং পরিশ্রমের, যথেষ্ট জনসংবর্ধনা না পেলে এর স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে যায়। শিক্ষাহীন বা নিম্নরুচির মানুষের দেশে বোকা বোকা ছবি তৈরি হওয়াই নিয়ম। আমাদের দেশের অধিকাংশ ছবিই ছিল সাধারণ শিল্পমানের অনেক নীচে, কয়েকটিতে সামান্য মাথা উঁচু করার চেষ্টা। এই সময় সত্যজিৎ রায় এই ছায়াছবির জগতে এলেন বামনের দেশে গালিভারের মতন। এই শিল্প মাধ্যমটি যে তাঁর প্রতিভার তুলনায় অনেক ছোট মাপের, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্রেই নয়, সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রে এরকম প্রতিভাবান যে কয়েকজন মাত্র এসেছেন তাদের সংখ্যা আঙুলে গুণতে গেলে একটা হাতও শেষ হয় না। সত্যজিৎ রায় অনেকটা রেনেসাঁস-কালীন মানুষের মতন। বহু বিষয়ে তার আগ্রহ এবং দক্ষতা। চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বহুদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। যে-কোনো বাংলা গ্রন্থ তাঁর অঙ্কিত প্রচ্ছদে সজ্জিত হলে বেশি সম্ভ্রম পায়। রায় চৌধুরীর পরিবারের বংশধর বলেই তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির ক্ষমতা স্বতঃসিদ্ধ ছিল না, তাঁকে আয়ত্ত করতে হয়েছে, আজ তিনি অতি জনপ্রিয় লেখক। দেশি ও বিদেশি সংগীতে তার যথেষ্ট পারদর্শিতা ও নেশা আছে। সার্থক সুরকার ও গান রচয়িতা হিসেবে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। অন্য যে-কোনো বিষয়ে তিনি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করলেও যে তিনি তার শিখরে উঠতেন, তা নিশ্চিত বলা যায়। এত বিভিন্ন ধরনের গুণাবলী নিয়েও যে তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে এসেছিলেন, এটা ভারতীয় চলচ্চিত্রের সৌভাগ্য। তিনি এই দুর্বল শিল্পটিকে তার সমান মাপে টেনে তুলতে চেয়েছেন। এবং তার আগমনের পরই বোঝা গেল, এতগুলি গুণের সমাবেশ না ঘটলে কারুর পক্ষে চলচ্চিত্র শিল্পকে মহৎ শিল্পে উন্নীত করা যায় না।
যখন তিনি প্রথম পথের পাঁচালি নির্মাণ করতে নেমেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন প্রায় সহায়-সম্বলহীন। কিংবা তাঁর সম্বল ছিল নিষ্ঠা ও জেদ। তারপর থেকে তিনি বহু দূরের পথ পার হয়ে এসেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দেখা গেছে, তার কীর্তিগুলির জন্য তিনি পেয়েছেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, কখনো বোধহীন স্তুতি এবং অনেক ক্ষেত্রে অহেতুক নিন্দা কিংবা ঈর্ষা-প্রসূত দংশন। অনেক সূক্ষ্ম দৃশ্য দর্শকের চোখ এড়িয়ে গেছে, অনেক জায়গায় ভুলভাবে গুণকীর্তন করেছে জনতা। তখন সত্যজিৎ রায় আবার কলম ধরেছেন দর্শককে শিক্ষিত করার জন্য।
সমালোচনাও যে-কোনো শিল্পীর কাম্য। ক্যামেরা, সম্পাদনা থেকে চরিত্র নির্বাচন, সংলাপ, এমনকি সুটিং-এর সময়ে নানা কৌতুকের দৃশ্য পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে লিখেছেন। কোনো জায়গাতেই তিনি গুরুগম্ভীর নন, কিংবা উপদেশ দিতে যাননি। যাদের নিজস্ব ধারণাই অপরিষ্কার, তাদের রচনাই দুর্বোধ্য হয়। যেহেতু সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রের অধিকাংশ শাখার শ্রেষ্ঠ মান নিজেই নির্মাণ করেছেন, সেই জন্যই তাঁর চিন্তা ও বর্ণনা এত স্বচ্ছ ও সাবলীল। চলচ্চিত্রকে যারা ভালোবাসেন এবং বুঝতে চান, তাদের এই গ্রন্থটি শয্যাসঙ্গী করার যোগ্য।
Reviews
There are no reviews yet.