এই গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলো এই দেশের কাছাকাছি সময়ের কয়েকজন সৃজনশীল মানুষকে কেন্দ্র করে, যারা বিদ্যমান আধিপতবাদী ব্যবস্থা, চিন্তা, দর্শন, সমাজ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী তাতে নিজস্ব ভ‚মিকা পালন করেছেন। এর মধ্যে তসলিমা নাসরিন গত আঠারো বছর ধরে নির্বাসিত, তাঁর চিন্তা ও লেখার কারণেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দুটো উপন্যাস এবং তাঁর চিন্তা, কাজ ও লড়াই নিয়ে লেখাগুলোই এই গ্রন্থের প্রধান অংশ। এখানে নেই কিন্তু গ্রন্থের বিষয় ও সময় বিবেচনা যাদের নিয়ে লেখা অবশ্যই থাকতে পারতো, কিংবা থাকা উচিত ছিল-এঁরা হলেন আহমদ ছফা ও আহমদ শরীফ। তাঁদের দুজনকেও এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি কোনোকিছুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তার মধ্যে নানা পরিবর্তন চলতেই থাকে। কিন্তু এই চলায় নানা মাত্রা থাকে, চলা ঠেকানোর বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রবণতা যেমন থাকে আবার চলার মধ্যেও নানামুখ থাকে। এই ভিন্নভিন্ন মাত্রা ও প্রবণতা তৈরি হয় সমাজের ভেতরকার নানা স্বার্থ ও স্রোতের কারণে। শ্রেণি-লিঙ্গ-জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর মধ্যেকার নিপীড়ন ও বৈষম্যভিত্তিক যে সমাজ তাতে ক্ষমতাবানদের দ্বারাই পরিবর্তনের কিংবা পরিবর্তন ঠেকানোর গতিমুখ নির্ধারিত হয় কিংবা সে চেষ্টাই জোরদার থাকে। কাজেই সংঘাতও থাকে চলমান। ক্ষমতাবানদের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়ে যারা ক্ষমতার ভাগিদার হন, রাজনীতি অর্থনীতির জগতে তো বটেই শিল্পসাহিত্য আর চিন্তার জগতেও তাদের দাপট আমরা জানি, প্রতিনিয়ত তা টের পাই। একই কারণে বৃহৎ জনগোষ্ঠী পিষ্ট হবার জগতেই আটকে থাকেন আর ক্ষুদ্র গোষ্ঠী অমানবিকতার অশ্লীলতার উৎসব করতে থাকে। এই অবস্থা চিরস্থায়িত্ব পায় না কারণ এই প্রবাহ সকলকে হজম করতে পারে না। কেউ কেউ এই পরিবর্তনকে বহুজনের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করবার কাজে, যুক্ত করবার উপযোগী করে এগিয়ে নেবার ব্রত নিয়ে সক্রিয় হন। স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিলে, স্রোতের গতি পরিবর্তন করতে চাইলে দায়িত্ব নিয়ে যুক্ত থাকতে হয়, নিয়ম ভাঙতে হয়, নিয়ম বিধি, দর্শন ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়। এর সবই যে সঠিক হয় বা কার্যকর হয় বা জনমনে ছাপ ফেলতে পারে তা নয়, কিন্তু তারপরও তা এক একটি বিদ্রোহকে চিহ্নিত করে যেগুলো কালে বৃহৎ চিন্তা ও কর্মকে শক্তি যোগায়। আমাদের সমাজ শুধু নয়, সব সমাজের অধিপতিশ্রেণি সবচাইতে সন্ত্রস্ত থাকে ভিন্নমতে, প্রশ্ন উত্থাপনে। তাদের প্রয়োজন চিন্তাহীন, প্রশ্নহীন, সৃষ্টিহীন, পরিবর্তনে অসার, বিশ্লেষণের ক্ষমতাহীন অনুগত জনগোষ্ঠী। আর মানুষের সমাজ দেখতে চাইলে আমাদের প্রয়োজন অন্ধভক্তি, প্রশ্নহীন আনুগত্য আর ঘৃণ্য আত্মসমর্পণের সংস্কৃতিকে পরাজিত করা; পরিবর্তনে সৃজনশীলতা আর মানুষকে জয়ী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। এটিই এই গ্রন্থের মূল বিষয়।
Sale!
Only logged in customers who have purchased this product may leave a review.
Reviews
There are no reviews yet.