প্রচলিত বহুবিবাহ প্রথা, মুসলিম নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া পর্দা-প্রথা রোকেয়ার সমসাময়িক সামাজিক জীবনে অবরোধের মতোই ভূমিকা রেখেছিলো। তৎকালীন সামাজিক জীবনে নারীর অসম অবস্থা ও নিপীড়নের ঘটনাতো আছেই। এসবই গভীর রেখাপাত করেছিলো। রোকেয়ার মানসে। এই অভিঘাত রোকেয়ার জীবন ও দর্শনের ভিত্তি নির্মাণে সাহায্য করেছে। তিনি তাঁর ভাবনাকে নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। আঘাত করেছেন আমাদের সংস্কারাচ্ছন্ন বোধ-বুদ্ধি ও কু-সংস্কৃতির দেয়ালে। উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গভারতের সামাজিক সংস্কৃতিতে জিইয়ে ছিলো এসব বাঁধা-বিঘ্ন ও কুসংস্কার। সেসময়ে নারীর হাতে ও পায়ে শোভা পেত অলঙ্কারের শিকল—এসবকিছুর বিরুদ্ধে রোকেয়া সোচ্চার হয়েছিলেন। দুঃস্থ ও নিপীড়িত নারীর দুঃসহ জীবনের কথা বিবৃত হয়েছে তাঁর রচনায়। সকল কাজে তাঁর প্রেরণার উৎস ছিলো ‘স্বপ্ন’, যে স্বপ্ন সুলতানা দেখেছিলো, দেখেছিলো পদ্মরাগের ‘সিদ্দিকা’। এই স্বপ্নের দর্শন ছিলো ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে টিকে থাকবে।
সর্বোপরি নারীর স্বতন্ত্র স্বরের কথা বলেছেন রোকেয়া। অনেক পরে নারীবাদীগণ এই স্বরের নাম দিয়েছেন ‘ভিন্ন স্বর’ বা ‘ডিফারেন্ট ভয়েস’। বাঙালির চিন্তার ইতিহাসে উনিশ শতকে এসে বিদ্যাসাগর এই স্বরকে দীপ্যমান করে তুলেছিলেন। নারীর মুক্তি ও সমতার দিকে অগ্রযাত্রায় রোকেয়া যুক্ত হয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। একজন আলোর অভিযাত্রী হিসেবে বুঝতে পেরেছেন নারীর স্বাধীন ও মুক্তভাবে টিকে থাকার অন্তরায় হলো সমাজের গভীরে প্রোথিত পুরুষতন্ত্র ও সামাজিক কু-সংস্কৃতি। সেই পুরুষতন্ত্র ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছিলেন, সংগ্রাম করেছিলেন।
সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পুরুষ পরিবারের প্রভু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, আর নারী তার অধ্যয়ন, কখনোবা সেবাদাসীতে পরিণত হয়েছে। রোকেয়া ইতিহাসের এই চলমান পাঠকে একটু পাল্টে দিয়ে নতুন আঙ্গিক দিতে চেয়েছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, হাজার বছরের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে নারী তার দাসত্ববৃত্তিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে। এ মেনে নেবার কারণ অনুসন্ধান ও এর প্রতিকারে নিমিত্তে তিনি তাঁর গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর দর্শন, কর্ম, চিন্তা ও প্রচেষ্টা দিয়ে সমাজে জ্বালাতে চেয়েছেন ‘জ্যোতির্ময় আলো। এ যেন “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো”-এ আলোকবর্তিকা নিয়ে রোকেয়া এগিয়েছেন। অবিচল, দীপ্ত ও দৃঢ় সেই পথচলা, যা তাঁর একান্তই নিজস্ব। এই নিজস্বতার মধ্যেই রোকেয়া বেঁচে আছেন। রোকেয়া দীর্ঘজীবী থাকুন আমাদের মননে, মানসে ও স্বপ্নে—যে স্বপ্নের বীজ তিনি বপন করেছিলেন পথে প্রান্তরে। সেই স্বপ্ন একদিন মহীরুহ হবে, পবিত হবে, শাখা ও ছায়ার করতলে আসবে সমতা ও মর্যাদার দাবি। ড. আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া তাঁর ‘রোকেয়ার মননে পাশ্চাত্য প্রভাব : গ্রহণ ও বর্জনের অভিঘাত’ গ্রন্থে সেই স্বপ্ন ও স্বরকে দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত দিতে চেষ্টা করেছেন।
Reviews
There are no reviews yet.